Hungry to Know

Monday, April 12, 2021

স্মার্ট ডিভাইসের নীল রশ্মি চোখের জন্য আসলেই কতটা ক্ষতিকর?

 

সারাদিন কম্পিউটারের সামনে বসে থেকে আমি নিজেই নাকি যন্ত্র হয়ে যাচ্ছি। এখন যদি পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলি - মানবদেহ আসলে তো একটা যন্ত্রই - তাহলে জনতা রাগান্বিত হবে। আবদুর রহমান বয়াতি বলেছেন - মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি, কোন মিস্ত্ররী বানাইয়াছে...। তাহলে আবদুর রহমান বয়াতিও কি যন্ত্র? কিন্তু কে শুনবে যুক্তির কথা!? এদের কে বোঝাবে কম্পিউটার বিজ্ঞান হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের দর্শন শাস্ত্র!


গবেষণা করে পাওয়া গেছে আমাদের চোখের ডাটা ট্রান্সফার রেট কম-বেশি প্রায় ১০ মিলিয়ন বিটস প্রতি সেকেন্ড, অথার্ৎ শুধু ইন্টারনেট কেবলের ভেতর দিয়েই ডাটা ট্রান্সফার হয়না। মানবদেহকে যদি একটি কম্পিউটার বা যন্ত্রের সাথে তুলনা করি তাহলে এর ইনপুট ডিভাইসগুলোর মধ্যে চোখের ব্যবহার অন্যতম। আবার চোখের মাধ্যমে আমরা যে সব সময় যে ডাটা ইনপুট নিয়ে থাকি তা নয়, আমরা কিন্তু আউটপুট-ও দিয়ে থাকি। যেমন রাগ, আনন্দ, প্রেম, ঘৃণা ইত্যাদি অভিব্যক্তিও কিন্তু চোখের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব। লোকে বলে - চোখের ভাষা না বুঝলে নাকি সে প্রেম কোন প্রেমই নয়! অতএব চোখের ডাটা ট্রান্সফার ঠিক থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বটে। 💞


কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, আমি আমার চোখ নিয়ে দুঃচিন্তা গ্রস্থ হয়ে পড়ছি। আমার মনে হয় আমার মতো যারা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার বা বিভিন্ন ডিভাইস এর সামনে বসে থেকে কাজ করেন তারা প্রত্যেকেই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। এবং শুধু কাজের জন্যই নয় এমন কি কাজ ছাড়াও বিনোদনের জন্য আমাদের বাসার ছেলে থেকে বুড়ো সকলেই এখন মোবাইল স্ক্রিনের দিকে নীরবে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকে। একে স্ক্রীন আসক্তি-ও বলছে, যা কোন ড্রাগ অ্যাডিকশনের চেয়ে কম মারাত্মক নয়।


যাইহোক স্ক্রীন আসক্তি নিয়ে অন্য আরেকদিন কথা বলা যাবে। তো এই চোখের যত্নে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে Blue-cut লেন্স। এই লেন্সটি মোবাইল, ট্যাবলেট, কম্পিউটার ও এই ধরনের আধুনিক যত ডিভাইস আছে তা থেকে যে ক্ষতিকর রশ্মি প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে তা প্রতিহত করতে পারে।


কেন এই রশ্মি প্রতিহত করা জরুরী? কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে - এসব ডিভাইস থেকে বের হয়ে আসা ক্ষতিকর নীল রশ্মি আমাদের চোখকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং চোখের নানান রোগের জন্ম দিচ্ছে যেমন ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, ছানি পড়া ইত্যাদি। আবার শুধু যে চোখ তা নয়, এমনকি এমনও বলা হচ্ছে যে এই রশ্মি ক্যান্সারের মতো রোগও সৃষ্টি করতে পারে।


এসব শুনে আর দশজনের মতো আমিও স্বাভাবিকভাবেই ঘাবড়ে গিয়েছি এবং ইচ্ছে হয়েছিল একটি Blue-cut লেন্স ব্যবহার করার। Blue cut লেন্স এমন ভাবে তৈরি যা ভেদ করে নীল আলো অপরপাশে পৌঁছাতে পারে না। আর নতুন কিছু কেনার সুযোগ পেলে তো মনটা এমনিতেই খুশি খুশি হয়ে যায়। কিন্তু নতুন জিনিস হাতে পেতে ভালো লাগলেও আমার আবার বাজার অ্যালার্জি আছে। তো দোকানীরা যা-তা বোঝানোর আগে নিজেই নেট-এ সার্চ করে একটু জেনে নিই কি ব্যবপার, যেমন - কত টাকা দাম, কোথায় ভালো পাওয়া যায়, ইউজার রিভিও কেমন ইত্যাদি।


তো ইন্টারনেটে নানান লেখা পড়তে পড়তে হঠাৎ সিবিসি নিউজের একটি লিংক এ চোখে পড়ল। রিপোর্টটি দেখে কপালের নিচে থাকা দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল এবং কপালের মধ্যে থাকা তৃতীয় নয়ন খুলে গেল। যা বুঝলাম চোখের যত্নে Blue-cut লেন্সে যতনা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে তারচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে ব্যবসায়িক বুদ্ধি। আসুন দেখি ব্যাপারটা কি!


প্রথমেই জেনে নেই এই লেন্স ব্যবহার না করলে যা যা সমস্যা হতে পারে বলে বলা হচ্ছে সেগুলোর একটা লিস্ট:

  • কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইসগুলির স্ক্রিন থেকে যে নীল রশ্মি বের হচ্ছে সেটি একটি ক্ষতিকর রশ্মি, চোখের ভেতরে ঢুকে তা চোখকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে।
  • এই নীল রশ্মি আপনার চোখের অবসাদগ্রস্ততার জন্য দায়ী।
  • এটা স্কিন ক্যান্সার তৈরি করতে পারে, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন হতে পারে এমনকি চোখের ছানি সমস্যা তৈরি করতে পারে।


তো যেটা বলা হচ্ছে যে বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস থেকে যে রশ্মি হয়ে আসছে তা ছোট ছোট চাকুর মত আমাদের চোখের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে এবং আমাদের রেটিনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কী ভয়ঙ্কর!


হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমাদের ম্যাকুলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু সেটা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে বের হয়ে আসা ক্ষতিকর নীল রশ্মির কারণে হচ্ছে এমন কিছু ডক্টর খুঁজে পাননি। বরং ডক্টর রেটিনা বা ম্যাকুলা ড্যামেজ থেকে বাঁচার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস, কিছু ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে তিনি গুরুত্বসহকারে নিতে বলেছেন। যেমন ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন এ - এগুলো চোখের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।


এবার আসা যাক অবসাদগ্রস্ততার বিষয়ে। দীর্ঘ সময় কম্পিউটারে তাকিয়ে কাজ করার ফলে আমরা যে চোখের অবসাদগ্রস্ততা বোধ করি এটা আসলে Blue light -এর কারণে নয়, বরং এটা দীর্ঘসময় এবং অপলকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য। এটার বিপরীতে ২০-২০-২০ নিয়মের কথা বলা হচ্ছে অর্থাৎ ২০ মিনিট পরপর ২০ ফুট দূরে ২০ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকা। এটি করতে পারলে চোখ অনেকটা রেস্ট পাবে, আপনার চোখ ভালো বোধ করবে।


কিন্তু এই কথাগুলো কোন অপটিক্যাল স্টোরের কোন বিক্রয়কর্মী তো বলছেই না, এমনকি বড় বড় কোম্পানির লিফলেট বা মার্কেটিং কনটেন্ট গুলোতেও নানা রকম সায়েন্টিফিক স্টাডির কথা দাবি করে blue-cut লেন্সকে বাজারে প্রতিষ্ঠিত করার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তারা সফল হচ্ছে। ডক্টর এর ভাষ্যমতে কোম্পানিগুলো তাদের কাস্টমারকে মিস লিডিং ইনফর্মেশন দিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের প্রোডাক্ট গুলো বিক্রি করার চেষ্টা করছে।




সিবিসি নিউজ-এর মূল রিপোর্টটাও এখানে যোগ করে দিলাম, ভেতরে বিস্তারিত আছে। আর আমি এতোক্ষণ ইন্টারনেটে সার্চ করে এটা সেটা পড়ে আপাত দৃষ্টিতে আমি যে উপসংহারে পৌঁছাতে পেরেছি তা হলো:

  • দীর্ঘসময় কম্পিউটারে বা যেকোনো ডিভাইসের কাজ করার ক্ষেত্রে ২০-২০-২০ নিয়ম পালন করা।
  • অন্ধকার ঘরে উজ্জল কোন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে না থাকা।
  • কম্পিউটার মনিটরের পেছনে কোন লাইট সোর্স / টেবিল ল্যাম্প রাখা যেন স্ক্রিনের চাইতে পেছনের আলোটা উজ্জল হয়।
  • চোখের জন্য উপকারী এমন খাবার গ্রহণ করা ও নিয়মিত ব্যায়াম করা।
  • কম্পিউটার স্ক্রিনে কাজ করার সময় নাইট লাইট অপশনটি অন করে রাখা।
  • কম্পিউটার স্ক্রিনের লাইট নিয়ন্ত্রণে f.lux সফটওয়্যারটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • পারলে ভালো কোম্পানির মোটামুটি ভালো মানের মোবাইল, ট্যাবলেট, কম্পিউটার মনিটর, ইত্যাদি ব্যবহার করা। 
  • এবং কোন নতুন প্রোডাক্ট কেনার আগে একটু অনলাইনে রিসার্চ করে নেয়া এবং নিজেকে দুটো প্রশ্ন করা
    • জিনিসটি আসলে-ই কাজের কিনা? বিপরীত মতামতগুলো কি?
    • জিনিসটি আসলে-ই আমার প্রয়োজন কিনা?


তো অবস্থা দৃষ্টে যা মনে হচ্ছে - এতোক্ষণ সময় ব্যয় করে শেষ পর্যন্ত আমার নতুন Blue-cut লেন্স-ই আর কেনা হলো না! 😪

© A.S.M. Shahriar Zahan

Photo by Ryutaro Tsukata from Pexels

No comments:

Post a Comment